রামসাগর দীঘি (Ramsagar Dighi) মানুষের খনন করা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দীঘি যা দিনাজপুর (Dinajpur) জেলার তেজপুর গ্রামে অবস্থিত। রামসাগর দীঘির আয়তন প্রায় ৪,৩৭,৪৯২ বর্গমিটার এবং গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। দীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি ঘাট রয়েছে। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে রামসাগর দীঘি অবস্থিত। রামসাগর দীঘিকে কেন্দ্র করে একটি মনোরম রামসাগর জাতীয় উদ্যান (Ramsagar National Park) গড়ে উঠেছে। এছাড়া পূর্ণিমার সৌন্দর্য উপভোগ করতে রামসাগরের পাড়ে ক্যাম্পিং খুবই মোহনীয় একটি বিষয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পলাশীর যুদ্ধের কিছুকাল পূর্বে রাজা রামনাথ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর পানির চাহিদা পূরণের জন্য এই দীঘিটি খনন করান। রাজা রামনাথের নাম থেকেই দীঘিটি রামসাগর দীঘি (Ramsagar Dighi) নামে পরিচিতি লাভ করে। চারপাশে সবুজ বৃক্ষময় রামসাগর দীঘিটি বর্তমানে পর্যটন বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। রামসাগর দীঘির সৌন্দর্যবর্ধন এবং পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে একটি আধুনিক রেস্ট হাউস নির্মাণ করেছে।
রামসাগর দীঘি
রাম-সাগর দিঘি নিয়ে প্রচলিত রয়েছে মজার লোককাহিনী। এই অঞ্চলে প্রাণনাথ নামে এক রাজা ছিলেন। সুশাসক ও প্রজাপ্রিয় রাজা বলে তাঁর দেশজোড়া খ্যাতি ছিল। তৎকালে দেশজুড়ে নেমে আসে প্রকৃতির নিষ্ঠুর তাণ্ডব। শুরু হয় একটানা অনাবৃষ্টি ও খরা। গোটা মৌসুমে একফোঁটা পানিও পড়ল না আকাশ থেকে। অনাবাদি রইল মাঠ। ফসল বা শস্য পাওয়া গেল না একমুঠো। দেশজুড়ে দেখা দিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। অনাহারে মরে শত শত মানুষ। জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হলো রাজভাণ্ডার। এতে খাদ্য সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও দেখা দিল পানীয় জলের অভাব। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি ও খরায় খাল-বিল, দিঘি-নালা শুকিয়ে খাঁ খাঁ। একফোঁটা পানি নেই কোথাও। রাজ্যজুড়ে শুরু হলো পানির জন্য আহাজারি। এমন পরিস্থিতিতে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন এক বিরাট দিঘি খনন করার। শুরু হলো দিঘি খনন। হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে খনন করে এক বিশাল দিঘি। কিন্তু এত গভীর করে খনন করা সত্ত্বেও দিঘির বুকে এলো না একফোঁটা পানি। হতাশা ও দুর্ভাবনায় বৃদ্ধ রাজা আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলেন।
আরও পড়ুন: সিলেটের জাফলং ভ্রমণের সকল তথ্য
নামকরণের ইতিহাস
একদিন রাজা স্বপ্নে দৈববাণী পেলেন, তাঁর একমাত্র পুত্র রামকে দিঘিতে বলি দিলেই পানি উঠবে। রাজার মুখে স্বপ্নাদেশ শুনে সারা রাজ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। কিন্তু রাজপুত্র রামের মনে কোনো বিকার নেই। নিজের প্রাণের বিনিময়ে প্রজাদের জীবন রক্ষা করতে রাজকুমার অবিচল। রাজার নির্দেশক্রমে দিঘির মধ্যস্থলে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করা হলো। এরপর গ্রামে গ্রামে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রজাদের জানিয়ে দেওয়া হলো, কাল ভোরে দিঘির বুকে পানি উঠবে।
পরদিন ভোর না হতেই রাজবাড়ির সিংহদ্বার খুলে গেল। বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া। হাতির পিঠে চড়ে সাদা কাপড় পরে যুবরাজ যাত্রা শুরু করলেন সেই দিঘির দিকে। যুবরাজ রাম সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দিঘির তলদেশ হতে অজস্র ধারায় পানি উঠতে লাগল। চোখের পলকে পানিতে ভরে গেল বিশাল দিঘি। পানিতে ভেসে রইল রাজকুমারের সোনার মুকুট। যুবরাজ রামের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে দিঘির নাম রাখা হলো রামসাগর।
আরও একটা লোককাহিনী শোনা যায়। রাজা রামনাথের দিঘি খনন করার পর পানি না উঠলে রাজা স্বপ্ন দেখেন, দিঘিতে কেউ প্রাণ বিসর্জন করলে পানি উঠবে। তখন স্থানীয় রাম নামের এক যুবক দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দিলে রাজার নির্দেশেই সেই যুবকের নামে দিঘির নাম রাখা হয় রামসাগর।
আর যা আছে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে
রাম-সাগর জাতীয় উদ্যানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা। যেখানে অজগর, বানর এবং কিছু হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী স্থান পেয়েছে। শিশুদের বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় শিশুপার্ক। পিকনিকের সুবিধা নিশ্চিত করতে রামসাগরে রয়েছে ৭টি পিকনিক কর্নার। এছাড়া ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর রামসাগর জাতীয় উদ্যানে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে রামসাগর গ্রন্থাগার নামে একটি পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস এবং ট্রেনে দিনাজপুর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সাধারণত ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে দিনাজপুরগামী বাসগুলি ছেড়ে যায়। বাস সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে নাবিল পরিবহন, এস আর ট্রাভেলস (০২-৮০১৩৭৯৩, ৮০১৯৩১২), এস এ পরিবহন (৯৩৩২০৫২), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (৮০১৩৭১৪, ৮০১৫৩৬৮), কেয়া পরিবহন (৯০০০৮১২), শ্যামলী পরিবহন (৯০০৩৩১) ইত্যাদি। নন-এসি এবং এসি বাস ভাড়া মানভেদে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা থেকে বেশ কিছু বাস দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
আরও পড়ুন: কান্তজীর মন্দির ভ্রমণ, দিনাজপুর
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেন দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রাত ৮টায় ছেড়ে যায়। আন্তঃনগর ট্রেন একতা এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে ছাড়ে। আর পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় বেলা রাত ১১টা ৩০ মিনিটে। শ্রেণিভেদে এইসব ট্রেনের টিকিট কাটতে ৫৭৫ টাকা থেকে ১,৯৭৮ টাকা লাগে।
দিনাজপুর থেকে অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে।
কোথায় থাকবেন?
রাম সাগরে অবস্থিত স্থানীয় বন বিভাগের বাংলোতে অনুমতি নিয়ে থাকতে পারেন। এই বাংলোর সাধারণ কক্ষ এবং এসি কক্ষে প্রতি রাতে থাকতে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা খরচ হবে।
দিনাজপুর শহরে ভালো মানের হোটেলে থাকতে চাইলে পর্যটন মোটেলে (০৫৩১-৬৪৭১৮) যোগাযোগ করতে পারেন। পর্যটনের হোটেলে ঢাকা থেকে বুকিং দিতে ৯৮৯৯২৮৮-৯১ নম্বরে ফোন করতে পারেন। পর্যটন মোটেলে ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন। কিংবা প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন দিনাজপুরের সাধারণ মানের হোটেলগুলিতে। সাধারণ মানের আবাসিক হোটেলের মধ্যে হোটেল ডায়মন্ড (০৫৩১-৬৪৬২৯), নিউ হোটেল (০৫৩১-৬৮১২২), হোটেল আল রশিদ (০৫৩১-৬৪২৫১), হোটেল রেহানা (০৫৩১-৬৪৪১৪), হোটেল নবীন (০৫৩১-৬৪১৭৮) ইত্যাদিতে ২০০ থেকে ১০০০ টাকায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন।
কোথায় খাবেন?
দিনাজপুরে রুস্তম, ফাইভ স্টার, দিলশাদ হোটেলে গরুর ভুনা মাংস, কাঠি কাবাব ইত্যাদি খেয়ে দেখতে পারেন। এছাড়া দিলশাদ রেস্তোরাঁর পাটিসাপটার বেশ সুনাম রয়েছে। এছাড়া পুলাহাট বিসিক এলাকায় আবুল হোটেলে ভাত, গরু কিংবা মুরগির মাংস, ডাল আর সবজি দিয়ে আহার সেরে নিতে পারেন।
Pingback: সিলেটের জাফলং ভ্রমণের সকল তথ্য - Sahojinfo
Pingback: কান্তজীর মন্দির ভ্রমণ, দিনাজপুর - Sahojinfo
Pingback: খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমণ গাইড - Sahojinfo
Pingback: মহামায়া লেক - Sahojinfo