খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমণ গাইড

খৈয়াছড়া ঝর্ণা

গন্তব্য যখন ঝর্ণা দেখা, তখন সেখানে স্বভাবতই চলে আসে পাহাড়ের গহীনে গুপ্ত কোনো প্রাকৃতিক শোভা আবিষ্কারের নেশা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্গম ঝিরিপথ পেরোবার দুঃসাহস এবং ধৈর্য। এই পাহাড়ি পথ প্রথমবারের মতো আসা যে কাউকে বিভ্রমে ফেলে দিতে যথেষ্ট।

কারণ সবেমাত্র পা রাখা পর্যটক এখনও জানেন না, ঠিক কতগুলো বাঁক ঘুরে শেষ হবে এই পিচ্ছিল পথ। এই রোমাঞ্চের পুরোটাই অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশের ঝর্ণার রানি খৈয়াছড়া ঝর্ণা।

খৈয়াছড়া ঝর্ণার ইতিহাস

খৈয়াছড়ার এই বিশাল ঝর্ণার ইতিহাস প্রায় ৫০ বছরের। ঘন ঝোপঝাড়ে ভরা ও দুর্গম হওয়ায় এই এলাকায় মানুষের পদচিহ্ন পড়তে অনেক সময় লেগেছে। কোনো এক সময় হয়তো প্রকৃতির খেয়ালেই পাহাড়ি ঢলের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই ঝর্ণার।

বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে শুরু করে কুণ্ডের হাট পর্যন্ত এলাকাটি বর্তমানে বড়তাকিয়া ব্লক নামে পরিচিত। এর ২৯৩৩.৬১ হেক্টরের পাহাড়ি জমিকে ২০১০ সালে ঘোষণা করা হয় সরকারি জাতীয় উদ্যান হিসেবে। সে সময় এই উদ্যানেরই প্রধান প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় এই জলপ্রপাতটি। স্থানীয়রা এই ঝর্ণাকে চতল বলে ডাকেন।

২০১৭ সালে সরকার এই ঝর্ণার সংরক্ষণের লক্ষ্যে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকা ছিল চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের রামগড়, সীতাকুণ্ড ও রিজার্ভ ফরেস্ট।

খৈয়াছড়া ঝর্ণার অবস্থান এবং নামকরণের কারণ

খৈয়াছড়া চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ঝর্ণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে খৈয়াছড়া অংশে বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর দিকে এই ঝর্ণার অবস্থান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে একদম ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলে দেখা মেলে এর। যে পাহাড়ে ঝর্ণাটির অবস্থান, সেটি খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ভেতরে পড়ায় ঝর্ণার নাম হয়েছে খৈয়াছড়া ঝর্ণা।

আরও পড়ুন: রামসাগর দীঘি, দিনাজপুর

পাহাড়ের একদম ভেতরে হওয়ায় ঝর্ণার পাদদেশ পর্যন্ত সরাসরি কোনো যানবাহন যেতে পারে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সিএনজি অটোরিকশা করে ঝর্ণা সংলগ্ন গ্রাম পর্যন্ত আসা যায়। কিন্তু এরপর থেকে গ্রামের ভেতর দিয়ে ঝর্ণার মূল ধারা পর্যন্ত পৌঁছানোর একমাত্র উপায় পায়ে হেঁটে যাওয়া।

খৈয়ছড়া ভ্রমণে যা দেখতে পাবেন

নয়টি বড় বড় ক্যাসকেড বা ধাপের এই ঝর্ণার প্রতিটি ধাপেরই রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। মীরসরাই ঠাকুরদা দিঘি থেকেও পাওয়া যায় পড়ন্ত জলের শব্দ। পথে যেতে যেতে পড়ে পাহাড়ের গহীনে, গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকা-বাঁকা পথ, বাঁশের সাঁকো, ক্ষেতের আইল, ও নানা আকৃতির ছড়া। অন্তত চারটি পাহাড় পেরোতে হয় উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য।

সবুজের গালিচা পেরিয়ে ঝুম ঝুম কলধ্বনি নিমেষেই দূর করে দেয় নিয়ত যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ। সেই সঙ্গে কিছুক্ষণ ঝর্ণা স্নান পরিশুদ্ধ করে দিতে যথেষ্ট।

এমন পরিবেশে তাঁবু খাটিয়ে একটি রাত কাটানো অপূর্ব এক অভিজ্ঞতার অবতারণা ঘটাবে। ঝর্ণার সঙ্গীত, ঝিঁঝিঁর ডাক ও জোনাকি পোকার আলো স্মৃতির মণিকোঠায় চির অম্লান হয়ে থাকবে। আর সৌভাগ্যবশত রাতটা যদি হয় পূর্ণিমার রাত, তাহলে তো জীবনের ষোল আনা পাওয়া হয়ে যাবে।

খৈয়ছড়া ঝর্ণা দেখার উপযুক্ত সময়

জলপ্রপাতকে তার নিজস্ব রূপের সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখতে হলে, ঢল, প্লাবন আর বৃষ্টির সময়কেই প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, ঝর্ণার সৌন্দর্যের মৌলিক উপাদানই তো জলের প্রবাহ। তাই স্বভাবতই বর্ষাকালই খৈয়ছড়া জলপ্রপাত দেখার ভালো সময়।

কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি-বাদলের সময় পাহাড়ি পথের বিপদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তাই মাঝ বর্ষায় না গিয়ে বর্ষা শুরুর আগে আগে কিংবা শেষ হওয়ার ঠিক পর পরই যাওয়াটাই ভালো।

ঢাকা থেকে খৈয়ছড়া ঝর্ণা যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে মীরসরাই

প্রথমে ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোর যেকোনোটি থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে উঠে পড়তে হবে। নন-এসি বাসগুলোতে ভাড়া পড়তে পারে ৪২০ থেকে ৪৮০ টাকা। আর এসিগুলোতে ৮০০ থেকে ১,১০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হতে পারে। এগুলোতে করে মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের কাছে এসে খৈয়ছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে নামতে হবে।

এছাড়া সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় লোকাল বাসে করেও খৈয়ছড়ায় পৌঁছানো যায়।

ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো আন্তঃনগর ট্রেনে এসে ফেনী স্টেশন পর্যন্ত আসতে হবে। শ্রেণিভেদে এখানে ভাড়া পড়তে পারে জনপ্রতি ২৬৫ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। ফেনী স্টেশন থেকে রিকশা কিংবা অটোরিকশায় ১০ থেকে ১৫ টাকা ভাড়ায় ফেনীর মহিপাল বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দেয়। এখান থেকেই বেশ কিছু লোকাল বাস খৈয়ছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে নামিয়ে দেয়।

মিরসরাই থেকে খৈয়াছড়া

খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে থেকে সিএনজি নিয়ে চলে যাবেন খৈয়াছড়া ঝর্ণার ঝিরির কাছে। ভাড়া নিবে ১০০ টাকা। অথবা পায়ে হেঁটেও যেতে পারেন। স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করলেই খৈয়াছড়া ঝর্ণা যাবার পথ দেখিয়ে দেবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে নেমে পূর্বদিকে ১০ মিনিট হেঁটে গেলে রেললাইন পাবেন। রেললাইন পার হয়ে আরও ১০/১৫ মিনিট হেঁটে গেলেই খৈয়াছড়া ঝর্ণার ঝিরির দেখা পাবেন।

এই ঝিরির কাছ থেকেই মূল ট্রেকিং শুরু করতে হবে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঝিরির পথ ধরে ৪০/৫০ মিনিট হেঁটে গেলেই ঝর্ণার দেখা পাবেন। এই ঝর্ণায় যাবার পথ একটাই। তাই পথ হারাবার ভয় নেই। চাইলে সাথে গাইড নিতে পারেন। তবে কোন দরকার নেই। কেননা পথে খৈয়াছড়া ঝর্ণাগামী অনেক পর্যটক পাবেন।

যাবার পথে খাবারের হোটেলে লাঞ্চের অর্ডার করে যাবেন। এই সব হোটেলে লাঞ্চ অর্ডার করলে ব্যাগ রাখা যায় বিনামূল্যে। অনেকের আবার জামাকাপড় পাল্টানোর রুমও থাকে। আর খাবার না খেলে প্রতি ব্যাগ ২০ টাকার বিনিময়ে হোটেলে রাখতে পারবেন। তাই পানিতে নামার পোশাক পরে, মোবাইল, ক্যামেরা আর টাকাপয়সা সাথে নিয়ে বাকি ব্যাগ এখানে রেখে যেতে পারেন।

বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে খৈয়াছড়া ঝর্ণা যাবার পথ বেশ পিচ্ছিল এবং দুর্গম হয়ে যায়। কাদার কারণে নরমাল জুতা পরে হাঁটা মুশকিল। মাঝে মাঝে পথ ছেড়ে পাহাড়ের উপরে উঠে যেতে হয়। তখন বয়স্ক এবং বাচ্চাদের জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: কান্তজীর মন্দির ভ্রমণ, দিনাজপুর

খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমণের সময় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

এই ঝর্ণার কাছে ও খৈয়াছড়ার বড়তাকিয়া বাজারে থাকার কোনো বন্দোবস্ত নেই। যারা তাঁবুতে থাকার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য ঝর্ণার পাদদেশে থাকার সুবিধা আছে। তবে রাত্রিযাপনের জন্য হোটেলে থাকতে হলে সীতাকুণ্ডই একমাত্র ভরসা। সেখানে মাথাপিছু ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকার মধ্যে মোটামুটি মানের রুম পাওয়া যাবে।

ট্রেকিংয়ের সময় বেশ কিছু খাবার হোটেল পাওয়া যাবে। সেখানে পছন্দের খাবারগুলো অর্ডার দিয়ে ফেরার পথে এসে খাওয়া যাবে। এখানে স্বল্পমূল্যে আনলিমিটেড ভাত-ডালসহ বিভিন্ন ধরনের তরকারি পাওয়া যায়। ১০০ টাকায় ভাতের সঙ্গে ফার্মের মুরগি পাওয়া যায়, আর দেশি মুরগি চাইলে সেটা বেড়ে ১৩০ টাকা হয়। সঙ্গে আলুভর্তা আর সালাদ যোগ করলে খরচ ১৪০ টাকা।

এ ছাড়া মিরসরাইতে মোটামুটি মানের কিছু খাবারের হোটেল আছে। তবে মনে রাখতে হবে, বিকেল ৫টার পর এখানকার সব খাবার হোটেল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর সীতাকুণ্ডে থাকার হোটেলের পাশাপাশি খাবারেরও ভালো কিছু রেস্তোরাঁ আছে।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

আশেপাশে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। সবগুলো মোটামুটি কাছাকাছি হওয়াতে একদিনে বেশ কয়েকটা কভার করা যায়। তবে এক রাত দুই দিন সময় নিয়ে আসলে প্রায় সবগুলো কভার করতে পারবেন। আপনার সময় বিবেচনা করে ট্যুর প্ল্যান সেভাবেই করবেন। এখানকার জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পটগুলো হলো:

  • সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক
  • চন্দ্রনাথ পাহাড়
  • নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা
  • নাপিত্তাছড়া ট্রেইল
  • কমলদহ ঝর্ণা
  • ঝরঝরি ঝর্ণা
  • বাঁশবাড়িয়া বীচ
  • গুলিয়াখালি বীচ
  • কুমিরা সন্দ্বীপ ফেরি ঘাট

খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমণের সময় কিছু প্রয়োজনীয় সতর্কতা

বৃষ্টির সময় ছাড়াও অধিকাংশ সময় ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তা বেশ পিচ্ছিল ও দুর্গম থাকে। বিশেষ করে একেবারে ওপরের ধাপগুলো খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয়। তাই ভালো মানের গ্রিপের জুতা পরে তবেই ট্রেকিং শুরু করতে হবে। এরপরেও তাড়াহুড়ো না করে সাবধানে ধীরে ধীরে প্রতি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
পানিতে এমনকি ঘাসেও জোঁক থাকতে পারে। তাই জোঁক ছাড়ানোর জন্য সঙ্গে গুল কিংবা লবণ রাখা যেতে পারে।
বিকেল নামতে না নামতেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যেতে শুরু করে। তাছাড়া সেখানে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্কের তেমন সুবিধা নেই। তাই সঙ্গে শতভাগ চার্জ দেওয়া পাওয়ার ব্যাংক এবং ভালো নতুন ব্যাটারির টর্চলাইট রাখতে হবে।
অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলের সময় আটকে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই যতটা সম্ভব সকাল সকাল এখানে আসার চেষ্টা করতে হবে।
সঙ্গে হালকা খাবার, পানির বোতল নেওয়া হলে সেগুলো যেখানে-সেখানে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলা, বিশেষত দোকান থেকে কিছু কেনা বা গাইডের সঙ্গে লেনদেনের সময় ভালো ব্যবহার করতে হবে। এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে স্থানীয় লোকজনসহ অন্যান্য ভ্রমণকারীদের অসুবিধা হয়।

শেষ কথা

ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্যে পাহাড়ি পথযাত্রা আর সব প্রমোদ ভ্রমণের থেকে আলাদা। আরাম-আয়েশের সঙ্গে ঝিরিপথ ঘুরে বেড়ানো এই অভিযানের সঙ্গে একদমই যায় না। পোকামাকড়ের কামড় কিংবা পা মচকে যাওয়া পাহাড়ের গহীনে ঢোকার উপরি পাওনা। ক্লান্তির কথা না হয় বাদই রইল।

তবে পথ হারানোর ভয় নেই, কারণ একই পথে আরও অনেক পর্যটককে পাওয়া যাবে। এরপরেও প্রয়োজনে সঙ্গে গাইড নেওয়া যেতে পারে। এই আশঙ্কা বা সম্ভাবনাগুলো বিনামূল্যেই মিলবে খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমণ প্যাকেজে। কিন্তু এ সবই কর্পূরের মতো উবে যাবে, যখনই সামনে এসে ধরা দেবে ঝর্ণার পুরো নয়টি ক্যাসকেডের মোহনীয় দর্শন।